“সংবিধান হল এমন একটি জীবন পদ্বতি যা রাষ্ট্র তার নিজের জন্য বেছে নিয়েছে”
এরিষ্টটল প্রদত্ত এ সংজ্ঞা থেকেই সংবিধান সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। সহজ করে বললে, প্রতিটি রাষ্ট্র তার নিজস্ব কিছু আইন-কানুন, নীতিমালা দ্বারা পরিচালিত হয়। আর এই সকল নিয়ম-নীতি সমূহ হল উক্ত রাষ্ট্রের সংবিধান।
মূলত সংবিধান (Constitution) হলো মৌলিক বিধিমালা নিয়ে লিখিত একটি দলিল। যা কোন রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সর্ম্পক নির্ণয় করে এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহারের ও বণ্টনের নীতি নির্ধারণ করে। বর্তমান বিশ্বে একটি দেশ পরিচালনা করার জন্য সংবিধান এক অপরিহার্য দলিল।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন।
বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের ইতিহাস
গণপরিষদ আদেশ অনুযায়ী সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে ১৯৭২ সালের ১১ই এপ্রিল, আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনকে সভাপতি করে ৩৪ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির একমাত্র মহিলা সদস্য বেগম রাজিয়া বানু (নারী আসন, জাতীয় পরিষদ), এবং এক মাত্র বিরোধীদলীয় সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।
১৭ই এপ্রিল এ কমিটির প্রথম বৈঠকের পরে ৩রা অক্টোবর পর্যন্ত এই কমিটি বিভিন্ন পর্যায়ে বৈঠক করে। জনগণের মতামত সংগ্রহের জন্য আহ্বান করা হয়। সংগৃহীত মতামত থেকে ৯৮টি সুপারিশ গ্রহণ করা হয়। ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশনে তৎকালীন আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন খসড়া সংবিধান বিল আকারে উত্থাপন করেন।
১৯ অক্টোবর তা প্রথম পাঠ হয় এবং ৩১ অক্টোবর ২য় পাঠ। সংবিধান লেখার পর এর বাংলা ভাষারূপ পর্যালোচনার জন্য ড. আনিসুজ্জামানকে আহবায়ক, সৈয়দ আলী আহসান এবং মযহারুল ইসলামকে ভাষা বিশেষজ্ঞ হিসেবে একটি কমিটি গঠন করে পর্যালোচনার ভার দেয়া হয়। খসড়া সংবিধানে ৬৫ টি সংশোধনী যুক্ত হয়।
এরপর ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হয়। পরে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ (মহান বিজয় দিবস) থেকে তা কার্যকর হয়। সংবিধান কার্যকর হওয়ার সময় রাষ্ট্রপতি ছিলেন বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী এবং প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
গণপরিষদে সংবিধানের উপর বক্তব্য রাখতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন,
“এই সংবিধান শহীদের রক্তে লিখিত, এ সংবিধান সমগ্র জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক হয়ে বেঁচে থাকবে।”
সংবিধান ছাপা ও অলংকরণ:
এ সংবিধান ছাপাতে ১৪ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছিলো। সংবিধান অলংকরণের জন্য শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের কমিটি করা হয়েছিল।
এই কমিটির সদস্য ছিলেন:
১. শিল্পী হাশেম খান
২. জনাবুল ইসলাম
৩. সমরজিৎ রায় চৌধুরী ও
৪. আবুল বারক আলভী।
শিল্পী হাশেম খান অলংকরণ করেছিলেন। হস্ত লিখিত সংবিধানটি মূল লেখক ছিলেন শিল্পি আব্দুর রউফ। ১৯৪৮ সালে তৈরী ক্র্যাবটি ব্রান্ডের দুটি অফসেট মেশিনে সংবিধানটি ছাপা হয়। মূল সংবিধানের কপিটি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
বাংলাদেশের সংবিধানের ভাগগুলো:
বাংলাদেশের সংবিধানটি ১১টি ভাগে বিভক্ত। ভাগগুলো হচ্ছে: প্রজাতন্ত্র, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি, মৌলিক অধিকার, নির্বাহী, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভা, আইনসভা, আইন প্রণয়ন ও আর্থিক পদ্ধতি, অধ্যাদেশ জারির ক্ষমতা, বিচার বিভাগ, নির্বাচন, মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, বাংলাদেশের কর্মবিভাগ, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, জরুরি বিধানাবলি, সংবিধান সংশোধন এবং বিবিধ।
সংবিধানের মূলনীতি :
সংবিধানে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা -কে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সংবিধানের কিছু বৈশিষ্ট্য:
১. লিখিত সংবিধান: এ সংবিধান একটি লিখিত সংবিধান। বাংলাদেশের সংবিধানটি ১১টি ভাগে বিভক্ত। এতে প্রস্তাবনা ১টি, তফসিল ৭টি ও ১৫৩টি অনুচ্ছেদ রয়েছে।
২. দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান: এ সংবিধান দুষ্পরিবর্তনীয় কিন্তু এই সংবিধান সংশোধন করা আবার খুব কঠিন কোন কাজও নয়! সংবিধানের দশম ভাগে মাত্র একটি অনুচ্ছেদ আছে (১৪২) আর এতে বলা আছে, বাংলাদেশে সংবিধান সংশোধনের জন্য দুই-তৃতীয়াংশ ভোটের প্রয়োজন হয়।
৩. রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ এই চার মূলনীতিকে আদর্শ ধরে কাজ পরিচালনা করেন।
৪. সংবিধানের প্রাধান্য: সংবিধানের ৭ নং অনুচ্ছেদে বলা আছে প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোন আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসমঞ্জস হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে।
৫.সংসদীয় সরকার: বাংলাদেশ সংবিধানে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। এ ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হয়। মন্ত্রিপরিষদ তাঁর কাজের জন্য আইন সভার নিকট দায়ী থাকে।
৬. এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থা: বাংলাদেশ এককেন্দ্রিক বিশিষ্ট সরকার দ্বারা পরিচালিত হয়। কেন্দ্রীয় সরকার এখানে সার্বভৌমত্ব ক্ষমতার অধিকারী। বাংলাদেশ একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র হওয়ায় এখানে এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা বলবৎ রয়েছে।
৭. এক কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা: এখানে এক কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা আছে আর এর নাম হল “জাতীয় সংসদ”। ১৯৭২ সালের সংবিধানে মোট ৩১৫টি সংসদ সদস্যদের জন্য আসন বরাদ্দ ছিল যার ভিতর ৩০০টি সাধারণ আর ১৫টি ছিল সংরক্ষিত নারী আসন। বর্তমানে এর সংখ্যা ৩৫০ করা হয়েছে।
৮. মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা: আমাদের সংবিধানের ৩য় বিভাগে এই বিষয়গুলি সন্নিবেশিত করা হয়েছে। এর মধ্যে চিন্তা করা, মতামত প্রকাশ, ধর্ম-কর্ম করা, চলা-ফেরা করা, বাক স্বাধীনতা, সম্পত্তির অধিকার ইত্যাদি বিষয়াবলী বর্ণিত হয়েছে। তবে এসকল অধিকাংশ অধিকারের উপর সংসদ বাধা-নিষেধ আরোপ করেছে।
৯. জনগণের সার্বভৌমত্ব: গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে বলা হয়েছে সকল ক্ষমতার উৎস হল জনগণ। এ দেশের সরকার জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটাধিকারের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়। এদেশের সরকার ভূত-ভবিষৎ জনগণের উপর নির্ভরশীল।
১০.সার্বজনীন ভোটাধিকার: এখানে সার্বজনীন ভোটাধিকারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এক ভোট এক নীতি হল বাংলাদেশের সার্বজনীন ভোটাধিকারে মূল ভিত্তি। আঠারো বছরের অধিক নাগরিকগণ এখানে জাতীয় যেকোন বিষয়ে ভোট দিতে পারবে।
সংবিধান সংশোধনী:
বাংলাদেশে সংবিধান সংশোধনযোগ্য তবে এ জন্য দুই-তৃতীয়াংশ ভোটের প্রয়োজন হয়।বাংলাদেশের সংবিধানের মোট ১৭ বার সংশোধন করা হয়েছে। সংবিধানের সর্বপ্রথম সংশোধনী হয় ১৯৭৩ এবং সংবিধানের সর্বশেষ সপ্তদশ সংশোধনী হয় ২০১৮ সালে।
সুপ্রীম কোর্ট কর্তৃক বাতিলকৃত সংশোধনীসমূহ:
সংশোধনীর মধ্যে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পঞ্চম সংশোধনী, হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সপ্তম সংশোধনী, ত্রয়োদশ সংশোধনী এবং ষোড়শ সংশোধনী সুপ্রীম কোর্ট কর্তৃক বাতিল করা হয়েছ।
এই সংবিধান সংশোধনের জন্য সংসদ সদস্যদের মোট সংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ ভোটের প্রয়োজন হয় যা সংবিধানের ১৪২ নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত হয়েছে। তবে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭খ তে বলা হয়ছে সংবিধানের ১৪২ নং অনুচ্ছেদে যা-ই থাকুক না কেন, সংবিধানের প্রস্তাবনা, প্রথম ভাগের সকল অনুচ্ছেদ, দ্বিতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদ, নবম-ক ভাগে বর্ণিত অনুচ্ছেদের বিধানবলী সাপেক্ষে তৃতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদ এবং একাদশ ভাগের ১৫০ অনুচ্ছেদসহ সংবিধানের অন্যান্য মৌলিক কাঠামো সংক্রান্ত অনুচ্ছেদের বিধানাবলী সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন, রহিতকরণ কিংবা অন্য কোন পন্থায় সংশোধনের অযোগ্য হবে।
দক্ষিণ এশিয়ার একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। স্বাধীন হবার পর অনেক বাধা পেরিয়ে ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক প্রগতি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। আর এ সংবিধান স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন।